➡️ সাধারণ অর্থে ‘অবহেলা’ বলতে যা বুঝা যায়, আইনগত অর্থে তা হতে কিছুটা ভিন্নতর বুঝায়। অমনােযােগিতা, অসাবধানতা, অযত্ন,
বেপরােয়াভাব ইত্যাদি আপাতদৃষ্টিতে অবহেলার সমার্থক প্রতীয়মান হয়।

➡️ অসাবধানতা দূষণীয়
নয়। কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করা যখন আইনগত কর্তব্য তখন অসাবধানতা নিঃসন্দেহে
সেই কর্তব্য লঙ্ন ও দূষণীয়।

➡️ অতএব বিবাদী কর্তৃক বাদীর প্রতি যে পরিমাণ যত্ন নেয়া কর্তব্য
তার অভাবকে অবহেলা বলা হয়।

➡️কিন্তু কি কারণে মানুষ প্রত্যাশিত যত্নবান হতে ব্যর্থ হয় তা অনুসন্ধান করা বেশ
গুরুত্বপূর্ণ।

➡️ অনবধানতা, হিসাব-নিকাশে ভুল, সংশ্লিষ্ট কাজে প্রয়ােজনীয় দক্ষতার অভাব, ভ্রান্ত।

🔹পূর্বধারণা ইত্যাদি কারণে এরূপ ব্যর্থতার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সকল কারণই সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়।

🔸গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে অবহেলাকে দুইভাবে বিভক্ত করা হয়; যথা-

➡️ সচেতন অবহেলা (willful negligenec)

➡️অবচেতন অবহেলা বা সহজ অবহেলা।

➡️সচেতন অবহেলা : কোনাে কাজের সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে যে ক্ষতি পূর্বেই অনুমান করা
যায় সে কাজকে সচেতন অবহেলার পর্যায়ে ফেলা হয়। জনাকীর্ণ রাস্তায় দ্রুতগতিতে
গাড়িচালনা করা নিঃসন্দেহে একটা অবহেলামূলক কাজ।

➡️এরূপ চালনার ফলে অন্যান্য পথচারী ও সে গাড়ির অন্যান্য আরােহীগণ যে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে তা গাড়ি চালক পূর্বেই
অনুমান করতে পারে।

🔸 জেনেশুনে সে বেপরােয়া গাড়িচালনা করলে এবং এর ফলে কারাে ক্ষতি
হলে উক্ত গাড়ি চালক সচেতন অবহেলার জন্য দায়ী হবে যদিও এরূপ ক্ষতি তার ইচ্ছাকৃত বা
অভিপ্রেত ছিল না। এরূপ অবহেলা আইনে দূষণীয়।

➡️অবচেতন অবহেলা : যেক্ষেত্রে সম্ভাব্য ক্ষতি পূর্বে অনুমান করা যায় না এবং এরূপ ক্ষতি
বিবাদীর অভিপ্রেত ছিল না সেক্ষেত্রে কোনাে অবহেলা থাকলে তা হবে অবচেতন অবহেলা বা
সাধারণ অবহেলা যা সচেতন অবহেলার ন্যায় সেরূপ দূষণীয় নয়। কোনাে চিকিৎসক
কোনােরূপ অসৎ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে এবং সরল বিশ্বাসে রােগীর আরােগ্য অভিপ্রায়ে অজ্ঞতার কারণে ভুল চিকিৎসা দেয় যার ফলে রােগীর আরাে ক্ষতি হয় তাহলে তা চিকিৎসকের অবচেতন অবহেলা বলা যায়। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপজ্জনক জেনেও যদি পরীক্ষামূলকভাবে কোনাে ওষুধ দেয় যা রােগীর ক্ষতি করে তাহলে তা সচেতন বা ইচ্ছাকৃত অবহেলা হবে।

➡️অবহেলার মতবাদ (Theories of negligence) : অবহেলা সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। তারমধ্যে স্যামন্ডের আত্মগত মতবাদ (Subjective Theory of Salmond) এবং পুলকের বস্তুগত মতবাদ (Objective Theory of Pollock) বেশ প্রসিদ্ধ। এ দুটো মতবাদ পরস্পর বিরােধী।

➡️স্যামন্ডের মতবাদ : স্যার জোন স্যামভের মতে, অবহেলা হচ্ছে ব্যক্তির মানসিক অবস্থান। এই মতবাদ অনুসারে অবহেলা একটা স্বতন্ত্র কাজ বা আচরণ নয়, কোনাে কাজ বা
এর পরিণতি সম্পর্কে ঔদাসীন্য বা উদাসীনতা।

🔸যদিও উদাসীনতা আর যত্নহীনতা বা
অনবধানতা এক বস্তু নয় তথাপি এটাও সত্য যে, উদাসীনতা মানুষের মনে অনবধানতা সৃষ্টি
করতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যদি কোনাে ব্যক্তি তার আচরণের ফলাফল সম্পর্কে উদাসীন থাকে, তাহলে সে সম্ভবত এই ফলাফল সম্পর্কে যথেষ্ট দূরদর্শিতা ও সচেতনতা
প্রদর্শন করতে ব্যর্থ ।

➡️পােলকের মতবাদ : পােলকের বস্তুগত মতবাদ অনুসারে অবহেলা সংঘটনকারীর কোনাে
আত্মগত বিষয় নয় বরং তা বাস্তব ঘটনাবিশেষ। অবহেলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মানসিক
অবস্থাবিশেষ বলে প্রবর্তিত সামন্ডের মতবাদকে পােলক সমালােচনা করেছেন। এবং একে স্বতন্ত্র বাস্তব আচরণ বলে উল্লেখ করেছেন। এই মতবাদ অনুসারে প্রয়ােজনীয় মানের
যত্নগ্রহণের কর্তব্য লঙ্নই হচ্ছে অবহেলা। যেমন রাতে দুর্ঘটনা পরিহার করার জন্য প্রত্যেকটি
স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বাতিসহ গাড়ি চালিয়ে থাকে।

🔹কোনাে ব্যক্তি বাতি ছাড়া রাতে
গাড়ি চালালে তা পরিমিত যত্ন গ্রহণে বা পূর্ব-সতর্কতা অবলম্বনের কর্তব্যের লঙ্ঘনস্বরূপ।এই
মতবাদ টর্ট আইনে দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়েছে। উইনফিল্ড বলেছেন যে, সাবধানতা অবলম্বন আইনবিজ্ঞান
আইনগত কর্তব্য তা লঙ্ঘনের ফলে বিবাদীর ক্ষতি সাধিত হলে তা অবহেলা হিসেবে চিহ্নিত হবে। ফৌজদারি আইনে অবহেলার জন্য ক্ষতির কারণে দোষী হতে হয়।

➡️অন্যান্য মতবাদ :
অস্টিনের মতানুসারে অন্যমনস্কতা বা অমনােযােগিতার দরুন অবহেলার সৃষ্টি হয়। সতর্ক।
বা সাবধানী হতে ব্যর্থ হওয়াই হচ্ছে অবহেলা। স্যামন্ড এই মতবাদকে অপর্যাপ্ত বলেছেন।

🔸কেননা যদিও অমনােযােগিতা অবহেলার সৃষ্টি করে কিন্তু সকল অবহেলার মধ্যে অমনযােগিতা
থাকে না কিংবা সকল অমনােযােগিতা অবহেলার সৃষ্টি করে না। রেলওয়ের সিগনাল দানকারী।

🔹ব্যক্তি যদি তার দায়িত্ব পালনকালে ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে তার ঘুমানাে দূষণীয় নয় বরং জেগে।
থাকার জন্য তার চিন্তার অভাব দূষণীয়।

🔹হল্যান্ডের মতানুসারে অবহেলা দু’ ধরনের হতে পারে,যথা সামান্য অবহেলা এবং বড় ধরনের অবহেলা। কিন্তু এই মতটি অতি পুরাতন এবং ইংলিশ আইনে তা গৃহীত হয়নি।

➡️অবহেলার শ্রিী (Degree of negligence) : রােমান আইনে মাত্রা হিসেবে দু ধরনের।
অবহেলা পরিলক্ষিত হতাে। যেখানে কোনাে অসৎ অভিপ্রায় থাকতাে না সেখানে সাধারণ
অবহেলা বলা হতাে এবং অসৎ অভিপ্রায় থাকলে তা মারাত্মক অবহেলা বলা হতাে। ব্রিটিশ
আইনে সাবধানতা অবলম্বনের মান একটাই স্বীকৃত এবং সেজন্য অবহেলার ডিগ্রীও একটা।

🔸কিন্তু বাস্তবে বিভিন্ন ডিগ্রীর প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ লােকের প্রতি
যদি যত্ন নেয়ার আইনগত কর্তব্য থাকে, তবে সেরূপ যুক্তিসঙ্গত যত্ন নিতে ব্যর্থতাই হচ্ছে
দূষণীয় অবহেলা। কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে এরূপ যত্ন নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে এবং কিরূপ মাত্রার
যত্ন নেয়া যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত হবে তা নির্ণয় করা সহজসাধ্য নয়। এটা একটা আইনের বিষয় বিধায় তা বিচারককেই নির্ণয় করতে হবে।

➡️যেমন, একটা মােটর গাড়ি চালক যখন
গাড়ির হর্ন, ব্রেক, ইত্যাদি যথাযথ কার্যক্ষম কি-না তা যাচাই করা এবং সাবধানে গাড়ি চালনা
করা তার কর্তব্য যেন অন্যান্য পথচারীদের কোনাে ক্ষতি না হয়। এই সাবধানতা অবলম্বনের
মাত্রা সব ক্ষেত্রে সমান নয়। ফাকা বা গ্রামের রাস্তার চেয়ে শহরে বা জনবহুল রাস্তায় এই মাত্রা একটু বেশি। আবার স্বাভাবিক সক্ষম লােকের চেয়ে অক্ষম, বধির, শিশু ও বৃদ্ধ লােকের প্রতি এরূপ সাবধানতার মাত্রা আরাে তীব্র। তাই দেখা যায় যে, যদিও মান সমান তবুও সাবধানতা অবলম্বনের মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে। কেউ বন্দুক নিয়ে চলাফেরার সময় যতটুকু সাবধানতা অবলম্বন করবে, শুধু একটা লাঠি নিয়ে চলাফেরার সময় ঐ পরিমাণ সাবধানতা অবলম্বনের
প্রয়ােজন হবে না।

➡️যত্ন নেয়া যুক্তিস
বিষয় বিধায় তা বিচারককেই নির্ণয় করতে হবে। কাজেই সাবধানতা অবলম্বনের মাপকাঠি নির্ভর করে কাজটি কিরূপ ঝুঁকিপূর্ণ
তার উপর, অর্থাৎ কাজ যত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে সাবধানতা অবলম্বনের মাত্রা তত বেড়ে যাবে।

🔸ট্রাফিক আইনে যত্নহীনতার বিভিন্ন গ্রেডের বিষয় উল্লেখ করা হয়। যুক্তিসঙ্গত যত্ন নিতে ব্যর্থতার ফলে অবহেলার সৃষ্টি হয় এবং তাতে ফৌজদারি দায়ের সৃষ্টি না হয়ে দেওয়ানি দায়ের সৃষ্টি হয়। যেখানে অধিক মাত্রায় সাবধানতা অবলম্বনের দায়িত্ব রয়েছে সেখানে এর ব্যর্থতা অপরাধমূলক অবহেলার (Criminal negligence) সৃষ্টি করে এর চেয়ে অধিক মাত্রায় বিচ্যুতি যার অন্যের মৃত্যু ঘটায় বা মারাত্মকভাবে আহত করে তাকে মারাত্মক অবহেলা (Gross Negligence) বলে।

🔹তাই দেখা যায় যে, অবহেলার মাত্রার তারতম্য বা ডিগ্রী বাস্তবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আইনেই করা হয়।

➡️আংশিক অবহেলা :
যেক্ষেত্রে বাদী ও বিবাদী উভয়েরই সতর্কতা অবলম্বনের দায়িত্ব এবং উভয়ের অসতর্কতার
জন্য বাদীর কোনাে ক্ষতিসাধিত হয় সেক্ষেত্রে বিবাদীকে এককভাবে দায়ী করা যায় না, বাদীও আংশিক দায়ী। এরূপ পরিস্থিতিকে বলে অবদানে অবহেলা বা আংশিক অবহেলা (Contributory negligence)।

➡️একে পারস্পরিক অবহেলাও বলা যেতে পারে ।
এই মতবাদ অনুযায়ী বিবাদীর অবহেলার মধ্যে বাদীরও কিছু অবহেলা জড়িত হয়ে কারণ।
ও ফলাফলের যােগসূত্র বিচ্ছিন্ন করে এবং বিবাদীর অবহেলা বাদীর ক্ষতির একমাত্র ও প্রত্যয়
কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় না।

➡️অন্যের প্রতি সতর্ক হওয়া ছাড়াও নিজের প্রতি সতর্ক হওয়া প্রত্যেকেরই কর্তব্য। একজন গাড়ি চালকের কর্তব্য হচ্ছে সাবধানে গাড়ি চালনা করা যেন অন্যান্য পথচারীর কোনাে ক্ষতি না হয়। কিন্তু পথচারীদের সাবধানে পথ চলার দায়িত্ব রয়েছে।

🔹একজন গাড়ি চালক তার ক্ষতি করতে পারে না, এরূপ বিশ্বাসে কোনাে পথচারী রাস্তার
মাঝখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এরূপ পরিস্থতিতে পথচারীর কোনাে ক্ষতি
হলে গাড়ি চালক এককভাবে দায়ী নয়। পথচারীর কার্যাবলি গাড়ি চালকের অবহেলায় অবদান রেখেছে বলা যায়।

➡️দায়ের উপাদান হিসেবে অবহেলা :
আত্মগত মতবাদ অনুযায়ী অবহেলা বা অসতর্কতা একটা মানসিক উপাদান। কিন্তু বিবাদীর মনের সাথে এর যথার্থ কোনাে সম্পর্ক নেই, প্রকৃত আচরণই একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।

🔹বিবাদী যদি যুক্তিসঙ্গত সাবধানতা অবলম্বন করতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে কারাে ক্ষতি সাধিত হয় তবে সে অবহেলার জন্য দায়ী। কোনটা যুক্তিসঙ্গত তা পরিস্থিতির আলােকে নির্ধারণ করতে হবে।

➡️বস্তুগত মতবাদ অনুযায়ী যেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন একটা আইনগত কর্তব্য সেক্ষেত্রে
এর ব্যর্থতা এবং ফলশ্রুতিতে কারাে ক্ষতি হলে অবহেলার জন্য দায়ী হতে হয়।
সমস্যার সমাধান : ডাঃ মাশরী একজন খ্যাতনামা শল্য চিকিৎসক। অস্ত্রোপচারের সময়
তাকে প্রয়ােজনীয় মাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু অস্ত্রোপচারের সময়
অসাবধানতার কারণে রােগীর পাকস্থলীতে একটি সূক্ষ্ম যন্ত্র থেকে যায়। এর ফলে পরে
রােগীকে পুনরায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। এখানে নিঃসন্দেহে ‘অবহেলা সংঘটিত হয়েছে।

➡️কিন্তু এটা একটা পেশাগত অবহেলা। যেখানে অহরহ এরূপ অস্ত্রোপচার ডাঃ মাশরী করছেন সেখানে ২/১টি এরূপ ঘটনা ঘটা খুব অস্বাভাবিক নয়। তাই এটাকে সামান্য অবহেলা (Simple
negligence) বলা যেতে পারে এবং দেওয়ানি দায় হিসেবে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়া যেতে
পারে।

🔹তবে কোনাে ব্যক্তির অবহেলার কারণে অন্যের মৃত্যু বা মারাত্মক শারীরিক আঘাত হলে
তা মারাত্মক অবহেলা (Gross Negligence) হিসেবে ফৌজদারি দায়ের উদ্ভবও হতে পারে ।
এক্ষেত্রে শাস্তি প্রদানও আইনসম্মত হবে ।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *